জাহাজ আবিষ্কারের আদি এবং আধুনিক ইতিহাস!

জাহাজ আবিষ্কারের আদি এবং  আধুনিক      ইতিহাস            

জাহাজ আবিষ্কারের ইতিহাস


জাহাজ, যা প্রাচীনকালে মানুষকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত এবং বাণিজ্য করতে সাহায্য করেছে, তা সভ্যতার প্রাচীনতম উদ্ভাবনগুলোর একটি। মানব ইতিহাসের সাথে সামুদ্রিক যাত্রা ও বাণিজ্য অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। পৃথিবীর প্রায় সকল প্রধান সভ্যতার উত্থান ও বিকাশের পেছনে জাহাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জাহাজ আবিষ্কারের ইতিহাস একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা হাজার হাজার বছর ধরে বিকশিত হয়েছে।

প্রাচীনকালের জাহাজ

জাহাজের ধারণা প্রাচীন যুগে শুরু হলেও এর প্রকৃত আবিষ্কার এবং উন্নয়ন বিভিন্ন ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। প্রাচীন মিশরীয়, ব্যাবিলনীয়, ফিনিশীয় এবং গ্রিকরা বিভিন্ন প্রকারের জাহাজ তৈরি করেছিল, যা মূলত বাণিজ্য, যুদ্ধ এবং যাতায়াতের কাজে ব্যবহৃত হত।

প্রাচীন মিশরীয়রা প্রায় ৩,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথমদিকের জাহাজ তৈরি করেছিল, যা ছিল প্রধানত নীল নদের উপর চলার উপযোগী। এসময়ের নৌযানগুলো ছিল প্যাপিরাসের বাঁশি দিয়ে তৈরি এবং এইসব নৌকাগুলো নদীর সাথে সাথে ছোট দূরত্বে বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে, মিশরীয়রা কাঠের নৌকা তৈরি শুরু করে। এই নৌকাগুলো সমুদ্র যাত্রার জন্যও ব্যবহার করা হতো।

মেসোপটেমিয়া এবং ব্যাবিলনীয় জাহাজ

মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনীয়রা তিগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর উপর জাহাজ চালাতো। তাদের জাহাজগুলো সাধারণত নদীর পাড়ে সহজে গমনাগমন ও বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হত। নদীর পানিতে ভাসার জন্য তাদের নৌকা ছিল ছোট, কিন্তু তারা নদী থেকে সমুদ্রে পৌঁছানোর উপযোগী নৌকাও তৈরি করেছিল।

ফিনিশীয়দের ভূমিকা

ফিনিশীয়রা জাহাজ নির্মাণ ও সামুদ্রিক যাত্রার ক্ষেত্রে প্রাচীন যুগের সবচেয়ে দক্ষ জাতি ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১২০০ সালের দিকে, ফিনিশীয়রা শক্ত কাঠের জাহাজ তৈরি করেছিল, যা ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্যিক এবং সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত। ফিনিশীয়রা জাহাজ চালিয়ে ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য করত এবং তারা তাদের জাহাজ ব্যবহার করে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের জাহাজের বিশেষত্ব ছিল এর দক্ষ নকশা, যা দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দিতে সক্ষম ছিল।

গ্রিক ও রোমান জাহাজ

প্রাচীন গ্রিসে জাহাজ ছিল প্রধানত বাণিজ্য ও যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত। তারা ট্রাইরেম নামক এক ধরনের জাহাজ তৈরি করেছিল, যা ছিল যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে গ্রিকরা সামুদ্রিক জাহাজ নির্মাণে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিল।

রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের প্রযুক্তিতেও উন্নতি আসে। রোমানরা তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তারের জন্য শক্তিশালী এবং উন্নত জাহাজ তৈরি করেছিল। তারা প্রধানত যুদ্ধ ও বাণিজ্যের জন্য জাহাজ ব্যবহার করতো এবং তাদের জাহাজগুলোর কাঠামোও ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী।

মধ্যযুগে জাহাজের বিকাশ

মধ্যযুগে, বিশেষত ৯ম থেকে ১৪শ শতাব্দীর মধ্যে, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ভাইকিংরা উত্তর ইউরোপে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেছিল, যা তাদের সমুদ্রপথে দ্রুতগতিতে চলার সুযোগ দেয়। ভাইকিং জাহাজ ছিল দীর্ঘ এবং সংকীর্ণ, যা সমুদ্রপথে সহজে চলতে পারতো এবং তারা দ্রুত আক্রমণ চালাতে সক্ষম ছিল।

একই সময়ে, আরব জাতি মধ্যপ্রাচ্যে উন্নত ধরনের জাহাজ নির্মাণ করেছিল, যা ভারত মহাসাগর, লোহিত সাগর এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হতো। আরবরা মূলত ‘ধৌ’ নামক জাহাজ তৈরি করত, যা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো।

ইউরোপে পুনর্জাগরণ ও নতুন জাহাজ

পুনর্জাগরণের সময় (১৪শ থেকে ১৭শ শতাব্দী), ইউরোপীয়রা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজ নির্মাণে বিশেষ অগ্রগতি লাভ করে। এই সময়ে জাহাজ নির্মাণে বিশেষ দক্ষতা অর্জনকারী দেশগুলো ছিল স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস এবং ইংল্যান্ড। নতুন নতুন পথ আবিষ্কারের জন্য ইউরোপীয়রা বৃহৎ আকারের জাহাজ তৈরি করেছিল। খ্রিস্টোফার কলম্বাসের বিখ্যাত জাহাজ ‘সান্তা মারিয়া’ ছিল একটি বড় আকারের জাহাজ, যা আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকা আবিষ্কারে সহায়ক হয়েছিল।

১৫শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা লম্বা সমুদ্র যাত্রার উপযোগী জাহাজ তৈরি করতে শুরু করেছিল। এই সময়ে তারা কারাভেল এবং গ্যালিয়ন ধরনের জাহাজ তৈরি করেছিল। এইসব জাহাজ বাণিজ্য ও যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত হত এবং এই সময়ে সমুদ্রযাত্রা আরো সহজ ও নিরাপদ হয়ে ওঠে।

আধুনিক যুগের জাহাজ

১৮শ এবং ১৯শ শতাব্দীতে বাষ্পচালিত জাহাজের আবিষ্কার জাহাজ নির্মাণে বিপ্লব ঘটায়। এই সময়ে বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার শুরু হয়, যা বাতাসের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেয় এবং যাত্রা আরও দ্রুত এবং নিয়মিত করে। ১৮০৭ সালে, রবার্ট ফুলটন প্রথম বাণিজ্যিক বাষ্পচালিত জাহাজ নির্মাণ করেন, যা নিউইয়র্ক থেকে আলবানি পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করত। এই ধরনের জাহাজ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য এনে দেয় এবং বাষ্প চালিত জাহাজগুলো বিভিন্ন মহাসাগরে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু করে।

১৯শ শতাব্দীর শেষের দিকে লৌহ এবং ইস্পাতের ব্যবহার শুরু হয়, যা জাহাজ নির্মাণকে আরও শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য করে তোলে। বাষ্পচালিত জাহাজের পরবর্তী পর্যায়ে ইঞ্জিনচালিত জাহাজ আসে। ২০শ শতাব্দীতে ডিজেল এবং তেলের সাহায্যে চালিত জাহাজগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে।

সমসাময়িক জাহাজ

আজকের দিনে, জাহাজ নির্মাণের প্রযুক্তি অত্যন্ত উন্নত হয়েছে। বর্তমানের আধুনিক কার্গো শিপ, ক্রুজ লাইনার এবং নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলো লোহা, ইস্পাত এবং অন্যান্য শক্তিশালী উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়। পাশাপাশি, ইলেকট্রনিক্স এবং কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় জাহাজ পরিচালনার জন্য। বর্তমানে, বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৯০% পণ্যবাহী জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়।

উপসংহার

জাহাজের আবিষ্কার ও বিকাশের ইতিহাস মানব সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রাচীনকালের প্যাপিরাস নৌকা থেকে শুরু করে আধুনিককালের শক্তিশালী ইস্পাতের জাহাজ—সবই মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রযুক্তিগত উন্নতির প্রতিফলন।

এরকম বিষয়ে আরো জানতে এই ওয়েবসাইটের সঙ্গেই থাকুন। এই ওয়েবসাইটে প্রতিদিন নিয়মিত নতুন নতুন বিষয় আপডেট হয়। এছাড়া এখানে রয়েছে বিশ্বের জানা অজানা তথ্য বা বিভিন্ন বস্তুর আবিষ্কারের ইতিহাস, রূপকথার মজাদার গল্প, সাফল্য নিয়ে বিখ্যাত মনীষীদের উক্তি, বিশ্ব বিখ্যাত মনীষীদের জীবন কাহিনী, শরীর সুস্থ রাখার গুরুত্বপূর্ণ টিপস ,ইসলামিক হাদিস এবং ইসলামের খুঁটিনাটি বিষয়, সাফল্য নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক গল্প বা স্ট্যাটাস ইত্যাদি। এই ওয়েবসাইটের লিঙ্ক https://www.mahadistoryworld.com

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

Mahadistoryworld Ads 2

whatsapp" viewbox="0 0 512 512" stroke="none" fill="currentColor">